[email protected] বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
২৩ মাঘ ১৪৩১

বুড়িগঙ্গার “বিবর্তন”

টাইমস মেইল ডেস্ক

প্রকাশিত: ২ জুন ২০২৪, ০৮:৩৯
আপডেট: ০২ জুন ২০২৪ ০৮:০৬

ফাইল ছবি

ঢাকার দক্ষিণ ও পশ্চিম পাশ দিয়েই বুড়িগঙ্গার বয়ে যাওয়া। ধলেশ্বরী নদী থেকে উদ্ভূত এই নদী। কিন্তু কথিত আছে, গঙ্গা নদীর একটি ধারা ধলেশ্বরী হয়ে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে মিশেছিল। যখন গঙ্গার সেই ধারাটির গতিপথ পরিবর্তন হয়, তখন গঙ্গার সাথে তার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তবে প্রাচীন গঙ্গা এই পথে প্রবাহিত হতো বলেই এমন নামকরণ।

বুড়িগঙ্গার উৎপত্তি নিয়ে লিখেছেন অনেক গবেষক বা লেখকরা। নীহাররঞ্জন রায় তার 'বাঙ্গালীর ইতিহাস' (আদি পর্ব) গ্রন্থে লিখেছেন, 'পদ্মার প্রাচীনতম প্রবাহপথের নিশানা সম্বন্ধে নিঃসংশয়ে কিছু বলা যায় না। ফান ডেন ব্রোকের নকশায় দেখা যাইতেছে পদ্মার প্রশস্ততর প্রবাহের গতি ফরিদপুর-বাখরাগঞ্জের ভিতর দিয়া দক্ষিণ শাহবাজপুরের দিকে। কিন্তু ঐ নকশাতে আরেকটি প্রাচীন পথেরও ইঙ্গিত আছে। এই পথটি রাজশাহীর রামপুর-বোয়ালিয়ার পাশ দিয়ে চলনবিলের ভিতর দিয়া ধলেশ্বরীর খাত দিয়ে ঢাকার পাশ ঘেঁষে মেঘনা খাঁড়িতে গিয়ে সমুদ্রে মিশিত। ঢাকার পাশের নদীটিকে যে বুড়িগঙ্গা বলা হয়, তাহা এই কারণেই। ঐ বুড়িগঙ্গাই প্রাচীন পদ্মা-গঙ্গার খাত।'

তখনের বুড়িগঙ্গা ছিল উত্তাল এক নদী। নদীর গভীরতাও ছিল বেশ। বিশাল প্রস্থের এই নদীর তীরে উঁচু উঁচু ডেউ এসে আছড়ে পড়তো। ফলে নদীপথে নানারকম দুর্ঘটনার শিকার হতো মানুষ।

অনেক ঐতিহাসিকের লেখায় বুড়িগঙ্গায় ঘটে যাওয়া অনেক দুর্ঘটনার উল্লেখও পাওয়া যায়। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তাঁর 'ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী' গ্রন্থে এমনই এক ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে ১৬৭৮ সালের পরে কেল্লা আওরঙ্গাবাদের দক্ষিণ ফটক বুড়িগঙ্গা কতৃক গ্রাস করে নেওয়ার কথা উল্লেখ করেন। এক সুবেদারের পালতোলা বজরা তলিয়ে যাওয়ার কথাও এই বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করেন তিনি। সেসময় এমন আরও অনেক ঘটনার সম্মুখীন হতো বলে নদীর রোষানল থেকে বাঁচতে লোকেরা চিনি-বাতাসা-পান দিয়ে নাকি ভ্যাটও দিতো। অবশ্য এর পেছনের কারণও বেশ শক্তিশালী। 

আজ থেকে ৪০০ বছরেরও বেশি সময় আগে এই বুড়িগঙ্গাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল ঢাকা নগরী। কিন্তু যাকে কেন্দ্র করে এই শহরের গোড়াপত্তন হয়, সেই নদীই আজ ধ্বংসের মুখে। আগের মত স্রোত নেই। উত্তাল ঢেউ এসে আঁচড়ে পড়ে না তীরে। নদীর বুক ছুঁয়ে ঠান্ডা বাতাসেরও দেখা মেলে না আর। সময়ের সাথে সাথে এই নদীর তীরে গড়ে ওঠে নানা শিল্প কারখানা। সেসব কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য এসে পতিত হতে থাকে বুড়িগঙ্গায়। 

ট্যানারি বর্জ্যের কারণে এই নদী এখন মাছশূন্য। কোনো জলজ প্রাণির বেঁচে থাকাই যেন দায়। নদীতে মাছ নেই বলে বিলুপ্ত জেলে পেশা। নেই জেলে পল্লীও। নদীর তীরে চর জাগতেই চলতে থাকে জমি দখল। কেটে ফেলা হয় চারপাশের গাছপালা। তারপর শুরু হয় দালান তৈরির কাজ। উচ্ছেদ করা হয় সেখানে বসবাসরত জেলেসহ নানা পেশার মানুষদের। এভাবে করে  নদীর পরিধিও কমতে থাকে ধীরে ধীরে। এমন সব কারণে বুড়িগঙ্গার ওপর  নির্ভর করে বেঁচে থাকা অনেক মানুষই হয়ে পড়েন কর্মহীন। অথচ তারাই ছিলেন এই প্রাণচঞ্চল নদীর মধ্যমণি।

'মুন্সিগঞ্জ ব্রিজ পার হয়েই দেখবেন কী সুন্দর স্বচ্ছপানি। কালো পানির কোনো চিহ্ন নাই। চারপাশের পরিবেশও সেই আগের মত। অথচ বুড়িগঙ্গা এর চেয়ে সুন্দর ছিলো এককালে। এখন তো নদীর পানির গন্ধেও কেউ লঞ্চের ছাদে যেতে চায় না। আগে প্রায় মানুষই ছাদে গিয়ে নদী দেখতো। চারপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করতো। এখনো সেসব দৃশ্য চোখের সামনে ভাসে আমার,' বলছিলেন যাত্রি নুরুল ইসলাম। 

ষাটোর্ধ্ব এই বৃদ্ধ ছোটবেলা থেকেই যাত্রা করেন নদীপথে। বাড়ি বরিশাল হওয়ায় লঞ্চই তার একমাত্র বাহন। তাই বুড়িগঙ্গার বুকে প্রায়ই যাতায়াত থাকে তার। নদীর এমন করুণ দশায় ব্যথিত তিনিও। এর পেছনে দায়ী করেন দূষণ এবং অবাধে জমি দখলকে। তিনি মনে করেন, এই দুটো জিনিসই পুরো নদীটাকে ঠেলে দিয়েছে ধ্বংসের দিকে।

বর্তমানে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই এই নদীতে। নেই আগের সেই জৌলুশও। শখের বশেও কেউ আর বেড়ানোর উদ্দেশ্যে ভীড় করে না। মধ্যরাতে দূর থেকে ভেসে আসে না শিয়ালের হাঁকডাক। নদীর বুকে চর জাগে না বলে কাশফুলের দেখা নেই দীর্ঘবছর। গাছপালার কোনো চিহ্ন নেই। বুড়িগঙ্গা এখন কেবলই এক দূষিত নদী। যে নদীর জল পান করে জীবন ধারণ করতো হাজার হাজার মানুষ, সে পানিই সবচেয়ে বিষাক্ত আজ। একটা সময় ঢাকার মানুষ হয়তো বলবে, নগরায়ন এবং আধুনিকায়নে সবচেয়ে বড় ক্ষতির শিকার এই বুড়িগঙ্গাই। 

সদরঘাটের মালামাল বহনকারী আব্বাস বুড়িগঙ্গার পারে কাজ করেন ২০ বছর ধরে। এই নদীর তীরেই তার বেড়ে ওঠা। নদীর রূপ-বৈচিত্র্য কিছুটা নিজের চোখে দেখেছেন তিনি। চোখের সামনে নদীর পানি নষ্ট হয়ে এভাবে দূষিত ও কালো হয়ে যাওয়ায় একরাশ অভিযোগ তার। 

আব্বাসের মতে, "কিছু কিছু লোক আছে, মায়ের কাছে বড় হইয়্যা মায়েরে ভুইল্যা যায়। উপকার করলে সেইটা মনে রাখে না। এমন লোক এইহানেও আছে। আজীবন নদীর খাইলো, পরলো, অথচ তারাই নদীটারে নষ্ট কইরা দিলো।"

 

 

এসআর

মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর